সম্ভবত: সাতের দশক। কলেজ স্ট্রীটের মোড়। কিছু জরুরী বই কিনতে গেছেন অভিনেতা তরুণকুমার। কিংবদন্তী নায়ক উত্তমকুমারের ছোটভাই ও খ্যাতনামা অভিনেতা। এমন সময় দেখেন পূটিরামে দাড়িয়ে 'তিনি'। পাহাড়প্রমান মিষ্টি কিনতে ব্যাস্ত। মুখোমুখি হতেই সেই অনাবিল হাসি।
"আরে বুড়া! যাস কই...?" ঢাকাই তোপ ধেয়ে আসে। তরুণবাবু বলেন। "বই কিনবি! তা বেশ বেশ...তবে তার আগে আমার লগে চ।" তরুণকুমার দেখেন ঘোর বিপদ। কিন্তু উপায় নেই! 'সিনিয়র' আর্টিস্ট ও অগ্রজ বলে কথা। একবার আমতা আমতা করে বলতে গেলেন "আসলে একটু কাজ ছিল যে..."। "ওসব পরে হইবো গিয়া। আমার লগে আয়। মিষ্টির হাড়িটা ল। আজ আমার মাস্টারমোসাই'র জন্মদিন। চল তর লগে আলাপ করামু গিয়া। দেখবি, খুব ভাল মানুষ।" এরপর আর কোন কথা চলেনা। 'তিনি' চলেন আগে আগে, পিছনে বিশালকায় মিষ্টির হাড়ি-প্যাকেট হাতে তরুণকুমার। কলেজ স্ট্রিট, হেদো ছাড়িয়ে বিবেকানন্দ স্ট্রীটের কাছে শীর্ণকায় গলি। তার মধ্যে ততোধিক ক্লিস্ট একটি বাড়ির সামনে দাড়ালেন 'তিনি'।
সন্ধে নেমেছে শীতের কলকাতায়। চারিদিক বেশ অন্ধকার। ঘরণী এক চিলতে তুলসীতলায় বাতি দিচ্ছেন। শাঁখ বাজছে কোথাও। তরুণবাবু ঠিক ঠাহর করতে পারছেনা যে কোথায় এলেন। একি অদ্ভুত রহস্য! এমন সময় বাড়ির বাইরে থেকেই আকাশবাতাস কাঁপিয়ে আবার 'ঢাকাই' গর্জন-"মাস্টারমোসাইইইই...আইসা পড়সি।" মাতৃসমা সেই মহিলা হেসে বললেন, "ভিতরে যাও বাবা..উনি বসে আছেন।" ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করে তরুণকুমারকে সাথে নিয়ে সামনের ঘরে সটান ঢুকে পড়লেন 'তিনি'।
খুবই অনাড়ম্বর, আটপৌরে ঘর। একটি খাট। তক্তপোষ। টেবিল চেয়ার। জলের কুজো। মশারি। এস্রাজ। এবং সব ছাপিয়ে ঘরভর্তি উপচে পড়া বই'র সাম্রাজ্য। সাদা চাদর জড়ানো এক অভিজাত প্রৌঢ় বসে। অন্ধকারে মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেননা তরুণবাবু। তখনো অগ্রজের নির্দেশে মিষ্টির হাড়ি হাতে একপায়ে দাড়িয়ে। গৃহিণী আলো নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই যেন মাটি দুলে উঠলো। তরুণবাবু দেখেন তার সামনে বসে আছেন বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এই তবে তার ভানুদার 'মাস্টারমোসাই'! ততক্ষণে গুরু-শিষ্য সংবাদ শুরু হয়ে গেছে। আচার্য ধীর কন্ঠে তার গৃহিণীকে বললেন "দেখেছো উষা (উষাবতী বসু) কেউ মনে রাখেনি...অথচ সাম্য কিন্তু কোনদিন ভোলেনা।" দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে হেসে ওঠেন 'তিনি'। গুরুমা'কে উদ্দেশ্য করে বলেন, "মাসীমা, মালপো খামু...আসে নাকি দুখান?" খুব কম লোকেই জানে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম সাম্যময় ব্যানার্জি এবং তিনি সত্যেন বসুর পদার্থবিজ্ঞান'র প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম।
আমরাও আপনাকে ভুলিনি ভানুবাবু...জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
No comments:
Post a Comment