মোবাইলের স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল গ্যাঁড়া৷ পরিস্কার টের পেল, একটা হিমশীতল ঠান্ডা স্রোত মেরুদন্ড বরাবর বিদ্যুত গতিতে বয়ে গেল৷ মুহুর্তের মধ্যে গোটা শরীর ঘেমে উঠল৷ হৃৎপিন্ডের গতিটা অস্বাভাবিক রকমের বাড়তে শুরু করল৷
বন্ধ দরজার ওপারে ততক্ষনে মায়ের বকবক শুরু হয়ে গেছে৷ ও জানে মা একটু বেশিই কথা বলে৷ আজ কেমন যেন আরও একটু বেশিই বলছে
—বদনের হইচে৷ সন্টারও হইচে৷ অনেকেই পেইচে৷ ঝিলিকের মাসির দেওরের বোনের মেয়ে পেইচে৷ পচির বাবাও৷ সবাই পেইচে৷ গাঁয়ে হয়নি এমন কেউ নাই৷
হোঁদলের হইচে বলে আমার গেদে আনন্দ লাগচে৷ বেচারা এতবার ধরে দিচ্চে৷ এবার ভগবান মুক তুলে চেয়েচে৷ যাক্ বাবা! ভালয় ভালয় কাছে পিঠে কুথাও একটা ঢুকে গেলেই বাঁচি৷
ও বাবা গ্যাঁড়া...উঠ উঠ উঠ...খবর পেইচুত?
ঘরের ভেতর গুমোট ভাবটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল৷ দরজায় দেওয়া প্রতিটা করাঘাত সোজাসুজি গ্যাঁড়ার স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত করছে৷ গ্যাঁড়া দরজা খুলে বাইরে বেরুনোর সাথে সাথেই, ঘরভেতরের গুমোট ভাবটা এক লহমায় গোটা বাড়িটাকে গ্রাস করে ফেলল৷ দুটো উৎসুক মুখের উপর মুহুর্তে কালো অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল৷
দরজা টা খোলা রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গ্যাঁড়া৷ রান্নাঘরে মা তখনও গজগজ করে চলেছে
—কপালে না থাগ্লে আর কি হবে৷ ভগবান যে এখন আর চোখে কানে দেখতে পায়নি৷ যাদে দরকার নাই তাদে ঘরে গন্ডায় গন্ডায় হচ্চে৷ আমাদে কপালে কি আর আছে! সব কপালের দোষ৷ না হলে বছর বছর দিচ্চে, হয়নি ক্যানে? যাদে কপালে আছে তাদে হচ্চে৷ গাড়ির ডেরাইভারের হচ্চে৷ দুদবালার হচ্চে৷ পেপারবালার হচ্চে৷ আমাদে ক্যানে হবেনি! সব কপাল, ভাগ্য৷
বাড়ি থেকে দুরত্ব বাড়ার সাথে সাথে মায়ের শব্দগুলো অস্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল৷
রাজুর চা দোকানে তখন মেলা ভিড়৷ ওর মনে হল সবাই বোধ হয় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে! সবাই বোধয় ওকে দেখেই হাসছে! সবাই বোধয় এতক্ষনে সব জেনে গেছে৷ 'গ্যাঁড়া পারেনি'!
ভীষন ভয় পেল, এই বোধয় কেউ জিজ্ঞাসা করে বসল
—কিরে গ্যাঁড়া! সবারির হল, তুই পাল্লিনি৷
ত্রস্ত পায়ে দ্রুত এই জায়গা টা পেরিয়ে যেতে চাইল সে৷ আজ বাবা বেঁচে থাকলে কিছু নিশ্চই বলত! বাবা আজ পর্যন্ত কখনও তাকে কিছু বলেনি৷ কোন ব্যাপারেই কখনও কিছু বলেনি৷ মা যতটাই বকবক করে, বাবা ঠিক ততটাই শান্ত! চুপচাপ৷ আজ প্রথম বলল৷ বাবার ফটোটার দিকে তাকিয়ে ও পরিস্কার শুনতে পেল
—এবারে হলে ভাল হত! এবারেরটা হবে ভেবেছিনুম৷
একটা ভারি পাথর বুকের ওপর ধীরে ধীরে চেপে বসছে৷ একটার পর একটা ফোন ওকে ক্রমশ আরও গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে৷ একটার পর একটা প্রশ্নবানে জেরবার হয়ে যেতে লাগল গ্যাঁড়া৷ উপদেশের বন্যা বয়ে যেতে লাগল মাথার উপর দিয়ে৷
—ভাল করে খাটতে হবে৷ এভাবে কত্তে হবে৷ ই এভাবে কচ্ছিল৷ হয়নি ক্যানে? হলনি ক্যানে? এটা করিসনি? এভাবে করিসনি????!!!!!
নিজেকে ভীষন বেচারা মনে হতে লাগল৷ নিজের কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছেনা এখন৷
ও জানে, অনেকেই আজ ওর সামনে সহমর্মিতা দেখালেও পিছনে ঠিক হাসছে৷ ওকে নিকৃষ্ট ভাবছে৷ ওকে নিয়ে মজা করছে৷ ওর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে৷ অনেকেই হয়ত হাঁফ ছেড়ে বাঁচছে!
—যাক্ ! গ্যাঁড়ার হইনি ভালই হইচে৷ মদমাতালের ঘরে আবার চৈতন্ন হবার শখ৷ শালা ঠিক হইচে৷ ভগবান বলে জিনিস আছেনা!
বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দুরে তখন জঙ্গলে অন্ধকার নেমেছে৷ জোনাকি গুলো আজ একত্রে বৃথা চেষ্টায়, গ্যাঁড়ার জীবনে আজ আলোর যে খুব প্রয়োজন৷
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে চেনা নম্বর টা ডায়াল করল গ্যাঁড়া..
—হ্যালো! রাই!
—অ! তুমি? হয়নি ত!
—.....না!
—আমি ত জানতুম৷ আচ্ছা ঠিকাছে এখন রাখ৷ আমি একটু ব্যাস্ত আছি৷
—তোমার ফোন ওয়েটিং দেখাচ্ছিল?
—পদুকে ফোন কচ্ছিলুম৷
—সেই ছ্যানাটা, যে তমার হাত ধরে টেনেছিল? তাখে!
—ছাড় দিখিনি উসব৷ পদুরও হইচে এবরে৷ দুটাই হইচে জান৷ আমারও ত হইচে৷ এবরে কুথাউ ঢুকতে গেলেত আরেকটু ভাল কত্তে হবে নাকি৷ এবরে কুথায় কি কত্তে হবে এই লিয়েই পদুকে ফন কচ্ছিলুম৷ দিব্যি কথা হচ্ছিল, আর তুমি সময় পেলেনি! যত্তসব!
—ও! ডিসটাব কল্লুম৷ থাক থালে এখন৷ পরে করব৷ কখন করব?
—আর কত্তে হবেনি৷ পদুর সঙ্গে অনেক দরকারি কথা আছে৷ ওদে ঘর যাচ্চি এখন৷ আর হ্যাঁ শুন, আমাকে এখন আর যখন তখন ফোন করবেনি৷ সামনে খুব চাপ! টেনশেনে আছি৷ পদুর সঙ্গে অনেক আলচনার বেপার আছে৷ বাবা আমাকে পদুর ঘরে দিয়ে এসবে, রাত করে ফিরব৷ এখন রাকচি৷
কেটে যাওয়া ফোনের নিভে যাওয়া লাইটের মতই গ্যাঁড়ার জীবনে আরও গভীর অন্ধকার ঘনীভুত হয়ে উঠল৷
মোবাইলের স্ক্রীনশটে তখনও প্রাইমারী, আপার প্রাইমারীর রেজাল্ট জ্বলজ্বল করছে৷
NOT QUALIFIED
গ্যাঁড়ার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগল৷ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করল৷ নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করল৷ কিন্তু....
পুরুষ মানুষের কান্না শোভা পায় না৷ পুরুষ মানুষ কাঁদে না৷পুরুষ হৃদয় আরও কঠিন হয়৷
No comments:
Post a Comment